কংগ্রেস নয়, মোদি জমানাতেই বেশি সোনা খুইয়েছেন মানুষ! প্রকাশ্যে যে ভয়ানক তথ্য

Economy of India: নোটবন্দী থেকে জিএসটি— এই প্রতিটি পদক্ষেপ যে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে, তা আজকে আর নতুন করে বলার নয়।

লোকসভা ভোটের দু'দফা নির্বাচন শেষ। তৃতীয় দফা নির্বাচন পর্ব মিটতেও আর বেশী দিন নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে এর মধ্যেই। যাঁদের কাঁধে দায়িত্ব ছিল, স্বচ্ছ অবাধ নির্বাচন পরিচালনার, তাঁরা মোটামুটি শাসকদলের কাছে, বিশেষত তাদের প্রথম সারির নেতাদের কাছে সঁপে দিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহার পড়ে, শাসক বিজেপির রাতের ঘুম উড়েছে। যেদিন থেকে কংগ্রেসের এই ন্যায়পত্র প্রকাশিত হয়েছে, সেদিন থেকেই নির্বাচনী আচরণবিধির তোয়াক্কা না করে, নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধ্যকতার সুযোগ নিয়ে, প্রধানমন্ত্রী থেকে বিজেপির তাবড় নেতানেত্রীরা কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ শুরু করেছেন।

একটি দেশের নির্বাচনে বিরোধী দলের নির্বাচনী ইস্তেহার যে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, তা এবারের লোকসভা নির্বাচন পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে। অনেকদিন ধরেই বহু অর্থনীতিবিদ এবং গণনাসংস্থা দাবি করে আসছে— দেশের সম্পদ ক্রমশ আরও বেশি কুক্ষিগত হচ্ছে ধনী এবং অতিধনীদের হাতে। তারা যেমন আরও বড়োলোক হচ্ছে, তেমনই আরও গরীব হচ্ছে বাকি জনতা। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন, তাতে দেখা গিয়েছে— অর্থনৈতিক ভাবে ধনী ১ শতাংশ মানুষের হাতেই কুক্ষিগত হয়ে আছে দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ। এবং ১ শতাংশের হাতে প্রতি বছর জমা হচ্ছে দেশের মোট বার্ষিক আয়ের ২২ শতাংশ।

এখান থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। কংগ্রেস তাঁদের ন্যায়পত্রে ঘোষণা করেছে, বিজেপি বিরোধী 'ইন্ডিয়া' জোট বা কংগ্রেস ক্ষমতায় আসলে, ভারতে অতিধনীদের সম্পত্তির একাংশের পুনর্বন্টন করা হবে। এই কথা প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং দলের বড়, মেজ, সেজ নেতারা সব ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, এবং ক্রমাগত নানা নির্বাচনী সভা থেকে তাঁরা মানুষদের ভুল বোঝাচ্ছেন। গত দশ বছরে, যাঁদের হাতে মূলত অর্থ, প্রতিপত্তি এবং বিত্ত কুক্ষিগত হয়েছে, তাঁরাই যে কংগ্রেসের এবং 'ইন্ডিয়া' জোটের মূল নিশানা, তা কংগ্রেসের ইস্তেহার থেকে স্পষ্ট। তার পরেও বিজেপি এবং বিশেষত প্রধানমন্ত্রী বিষয়টাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন, মধ্যবিত্তের দিকে। এমন ভাবে প্রচার করা হচ্ছে, যাতে মনে হয়, মধ্যবিত্ত এবং একটু উচ্চ মধ্যবিত্তের থেকে টাকা, সম্পত্তি এবং সোনাদানা যেন কংগ্রেস কেড়ে নিতে চাইছে। আর তা কেড়ে নিয়ে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াটাই যেন কংগ্রেসের উদ্দেশ্য। যে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল ধনী এবং অতিধনীদের সম্পত্তির পূণর্বন্টন নিয়ে, তা কী করে সার্বজনিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, বাসস্থান ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করা যায় তা নিয়ে। অথচ তার বদলে সেই আলোচনাকে ঘুরিয়ে দেওয়া হল এমন ভাবে, যাতে মনে হয় হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নিয়ে, 'ঘুসপেটিয়া' বলে দেগে দেওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিলিয়ে দেবে কংগ্রেস। এমন একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, যে গত দশ বছরে যেন মধ্যবিত্তের সঞ্চয় বিশালাকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর কংগ্রেস ও তার জোটসঙ্গীরা যদি ক্ষমতায় আসে সেই সঞ্চয়ে টান পড়বে, জমিয়ে রাখা
সোনার গয়না অবধি কেড়ে নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন: ২০০৩-২০২৪: যে ভাবে বারবার মুসলিম-ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে

অথচ তথ্য কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কথা বলে। কিছুদিন আগে কলকাতায় একটি সভায় বক্তব্য রাখতে এসে অর্থনীতিবিদ পারাকালা প্রভাকর বলছিলেন, গত দশ বছরে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় শুধু কমেছে, তা-ই নয়। তাদের দেনা অর্থাৎ গার্হস্থ্য ঋণও বেড়েছে লাফিয়ে। আর এই তথ্য যে শুধু তিনি বলছেন এমনটা নয়, অর্থনৈতিক নানা সমীক্ষাতেও একই তথ্য উঠে এসেছে। যতই প্রধানমন্ত্রী বলুন না কেন, কংগ্রেস মধ্যবিত্তদের জমানো সোনা এবং টাকা মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে, যতই টাকা পয়সা দিয়ে গালগোটিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা হোক না কেন, গত দশ বছরে মানুষ কিন্তু অর্থনৈতিক বাধ্যবাধ্যকতার কারণে সবচেয়ে বেশী ঋণ নিয়েছেন সোনা বন্ধক রেখে। যদি তা না হত, মুথুট ফাইন্যান্স, মনপ্পুরম গোল্ড লোন ইত্যাদি সংস্থারা এমন ফুলেফেঁপে উঠত না। যাদের বিজ্ঞাপনে খোদ অমিতাভ বচ্চনের মতো অভিনেতাকে দেখতে পাওয়া যায়। এর আগেও যে বন্ধকি কারবার ছিল না এমনটা নয়, শহর থেকে মফস্বল এবং গ্রামে গঞ্জেও এই সুদখোর বন্ধকিদের দেখা যেত। ছোট ছোট সোনার দোকানের ব্যবসায়ীরা এই কাজটাই করতেন। গত দশ বছরে যা হ্রাস পাওয়ার কথা ছিল,তা শুধু বাড়েইনি, অনেক বেশী প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, শুধুমাত্র ২০২৩- ২৪ সালেই সোনা বন্ধক রেখে এক লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় এই ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ বেশী। এত দ্রুতগতিতে এই ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়াটা যথেষ্ট আশঙ্কাজনক বলেই জানিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।

নোটবন্দী থেকে জিএসটি— এই প্রতিটি পদক্ষেপ যে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে, তা আজকে আর নতুন করে বোধহয় কাউকে বলে দিতে হয় না, কিন্তু একটি পরিবার যখন তাঁদের শেষ সঞ্চয় বাড়ির গয়না বিক্রি বা বন্ধক রাখতে বাধ্য হয় এবং সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে বাধ্য হয়, তখন বোঝা যায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট বেহাল। মোট ব্যক্তিগত ঋণের মধ্যে ২০১৯ সালে এই সোনা বন্ধক দিয়ে ঋণের পরিমাণ ছিল ১ শতাংশ। কোভিডের সময়ে সেই ঋণ বেড়ে হয় ২.৫ শতাংশ। তার পরের বছরে তা কমে ২ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও এই ঋণের পরিমাণ ২ শতাংশের নীচে নামেনি। অর্থাৎ নোটবন্দী থেকে যে অর্থনীতির নিম্নগামী যাত্রা শুরু হয়েছে, তা ২০২৪ সালে এসে এতটুকু কমেইনি, বরং বেড়েছে। অর্থাৎ মোদি এবং তাঁর চ্যালা-চামুণ্ডারা যতই বলুক, ভারত আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসবে, দেশের অর্থনীতি পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে, তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোনও সম্পর্ক নেই। দেশের মানুষ রোজ আর্থিক ভাবে মারা যাচ্ছেন। কিংবা তা থেকে বাঁচার জন্য ঋণের জালে জর্জরিত হচ্ছেন। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার সমান কত টাকা, বা সেই সংখ্যায় কতগুলো শূন্য থাকে, তা বোঝার মতো ক্ষমতা কিন্তু সাধারণ মানুষের নেই।

এর সঙ্গে যদি সোনা কেনার প্রবণতাকে যুক্ত করে দেখা যায়, তাহলে কি সেক্ষেত্রেও বিরাট কিছু উলম্ফন ঘটেছে? তথ্য কিন্তু তা বলছে না। একদিকে সোনার দাম বেড়েছে, অন্যদিকে মানুষের আয় কমেছে, ফলত এক দশক আগেও যেভাবে মানুষ সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সোনা কিনে রাখতেন, তা এখন কমেছে অনেকটাই। উল্টে দেখা যাচ্ছে, সোনা আমদানিও গত পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ শতাংশ কমেছে। অনেকে বলতে পারেন, আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ। কিন্ত সেটাই একমাত্র কারণ নয়। ভারতের বহু মধ্যবিত্ত মানুষের আয় গত দশ বছরে এতটাই কমেছে, যে তাঁরা সোনা কেনার কথা আর ভাবতেই পারছেন না। যতই ধনতেরাসের মতো উৎসব আসুক না কেন, মানুষ সোনা কেনার মতো উদবৃত্ত আয় করছেন না বা সঞ্চয় করতে পারছেন না। আর এটাই বাস্তব তথ্য। নরেন্দ্র মোদি তাঁর নির্বাচনী ভাষণে যতই তাঁর পূর্বসূরী প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করুন না কেন, যতই নির্বাচন কমিশনের আচরণ বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রচার করুন না কেন, যতই মধ্যবিত্তদের মধ্যে ভয় সঞ্চার করার চেষ্টা করুন না কেন, যে তাঁদের পরিবারের সোনার গয়না এমনকী মহিলাদের বিবাহের চিহ্ন মঙ্গলসূত্র কংগ্রেস কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিলি করে দেবে, সত্যিটা কিন্তু এটাই যে ভারতীয়রা এই দশ বছরে সবচেয়ে বেশী সোনা বিক্রি বা বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছে।

আরও পড়ুন: টুকরে টুকরে গ্যাং’-এ ভেঙে মহারাষ্ট্রের রাজনীতি! ভোটে তার কতটা ফায়দা তুলতে পারবে বিজেপি

যত জোরে সঙ্গেই প্রচার করা হোক না কেন, শাক দিয়ে কিন্তু আর মাছ ঢাকা যাচ্ছে না। মানুষ কিন্তু নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বে অর্থনৈতিকভাবে খুব ভালো নেই, আর সেই ভালো না থাকার বিষয়টা আর কেউ না বুঝুক, নরেন্দ্র মোদি বিলক্ষণ বোঝেন। আর বোঝেন বলেই, তিনি ভীত এবং সন্ত্রস্ত। আর সেই জন্যেই তিনি সারাক্ষণ হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতি করছেন। কারণ তিনি এটা জানেন, মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং তাঁর দেওয়া ভাঁওতাগুলো বুঝতে শুরু করে, তাহলে সামনের দিন ভয়ঙ্কর। সেই জন্যেই তিনি ইদানিং আর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ বলছেন না। তাঁর ন্যারেটিভ এখন সম্পুর্ণ মেরুকরণের ন্যারেটিভ, কারণ তিনি জানেন। জিততে হলে তাঁকে হিন্দুদের ভোটেই জিততে হবে। কিন্তু শেষ প্রশ্নটা থেকেই যায়, সমস্ত হিন্দুরা, যাঁরা বাধ্য হয়ে তাঁদের পরিবারের শেষ সম্বল বিক্রি বা বন্ধক দিয়েছেন, তাঁরা সবাই নরেন্দ্র মোদির আজকের কথাগুলোকে বিশ্বাস করছেন তো?

More Articles